রাত ১২টায় মাইক্রো স্টার্ট। ধীরে ধীরে, চলতে চলতে আর পথের
মাঝে নানান জায়গায় টি ব্রেক দিতে দিতে, ভোর ৫টায়
পৌঁছাই কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার মরিচখালী। ফোন
পেয়ে আগেই বাজারে এসে অপেক্ষায় ছিল,দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ’র
অন্যতম ভ্রমণ বন্ধু তরিকুল। তার সঙ্গে মুলাকাত করে, ফজরের নামাজ
আদায়ের জন্য মসজিদে ঢুকি। নামাজ শেষেই চলে যাই ইন্দা
গ্রামের নৌঘাটে। বাজার-সদাই চুলা পাতিল নিয়ে চড়ি
ট্রলারে। সব ঠিকঠাক, মাঝি ট্রলার ভাসালো নরসুন্দা নদীর খালে।
ট্রলার চলতে চলতে, খাল পেরিয়ে ঘোড়া উতরা নদী ছাড়িয়ে নিকলির
ছাতিরচর পানে। এরই মধ্যে সকালের নাশতার জন্য, খিচুড়ি রান্নার
কসরত শুরু।
যেতে যেতে একসময় দূর থেকেই চোখে ধরা দেয়,ডুবোচরে
জেগে থাকা সারিসারি হিজল-কড়চ গাছ। এ এক অনিন্দ
ভালোলাগার হাতছানি। সামনে যেতেই চোখ সবার কপালে।
বাঁকা তেড়া শতশত গাছ। বছরের ৬ মাস প্রায় ডুবে থেকেও,
বেঁচে থাকার নামই হিজল-কড়চ গাছ। চরটা অসাধারণ
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা। আকাশ পানে তাকিয়ে দেখি,
নীলের বদলে ফিরোজা।দূরের শুভ্র মেঘমালা দেখে মনে হয়, এ যেনো
কোন পর্বত চূড়া।
সব মিলিয়ে ভোরের হাওয়ায়, নিকলী হাওরের আকাশটা অন্যরকম ভালোলাগার। এরকম মায়াবী নয়নাভিরাম
পরিবেশে, গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে হাটু পানিতে হেঁটে
বেড়াই। হাওরের ঝিরঝির বাতাসে হ্যামোক ঝুলিয়ে দোল খাই।
কথায় আছেনা সকালের হাওয়া-লাখ টাকার দাওয়া। কে চায়? বিনে
পয়সায় সেই সুযোগ ছাড়তে। জীবনের মানে খুঁজে পেতে
চাইলে, ছাতিরচরের জুরি নেই। ইতিমধ্যে কলাপাতায় খিচুড়ি
রেডি। ইচ্ছেমত গোগ্রাস করে,ছুটলাম এবার অষ্টগ্রাম হাওরের
পথে । নিকলী বেড়ীবাঁধ পাশ কেটে,ট্রলার চলে মোজনা বিলে।
ভাসতে ভাসতে বিশাল হাওরের বুকে। কুল নেই কিনার নেই-নেই
কোন জনমানবের বসতি। সাগর আর হাওর এই দুয়ের পার্থক্য যেন
বুঝা বড় দায়। কিশোরগঞ্জের প্রায় ৯৭টি ছোটবড় হাওর
নেত্রকোণা,সুনামগঞ্জ,হবিগঞ্জ ও বি.বাড়ীয়া জেলার বিভিন্ন
বিল-হাওরের সাথে মিশে একাকার।
দেশের মিঠাপানির মাছের চাহিদা, অনেকাংশই মিটে এসব হাওরের জলাশয় হতে। ট্রলার
চলছে,প্রায় আড়াইঘন্টা লাগবে অষ্টগ্রাম পৌঁছতে। এই দীর্ঘ
সময়ে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ’র দামালেরা নেচে-গেয়ে উল্লাস করে।
দুপুরের রান্নার জন্য রফিক-নাজমুল হাসের চামড়া ছিলে।
মাঝেমধ্যে জেলে নৌকার দেখা মিলে। তাদের কাছ থেকে কেনা,
হাওরের টাটকা চিংড়ী ভাজায় রসনা মিটে। পনকৌড়ির উড়ে
বেড়ানোর ঝাক দেখতে দেখতে ঘন্টা দেড়েক পরে, ট্রলার পড়ল
ধলেশ্বরী’র বুকে। প্রমত্তা ধলেশ্বরী নদী। অথচ নারায়নগঞ্জে এসে চরম
মার খেয়েছে ।
ঘড়ির কাটা প্রায় বারোটা। চোখে আটকায় অষ্টগ্রামের
সবচাইতে দৃষ্টি নন্দন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ সেতুর উপরে।
নজরকাড়া সৌন্দর্যমন্ডিত সেতুটি, দেখেই চোখ জুড়ালো।
ট্রলার ভিড়ে থানা ঘাটে। নেমে যাই পানিতে। ডুব সাতারে
মেতে উঠে, দে-ছুট এর সব দামালেরা। জসিম-উজ্জল ওরা দুজন
হাওরের পানিতে, যেন ফিরে পায় তাদের হারানো যৌবন। আর
কাইউম ভাই,তার কথা আর নাই বললাম। জুম্মা নামাজের তাড়া।
যেতে হবে প্রায় দুই কিলো দূরে হযরত কুতুব শাহ জামে
মসজিদে। আর দেরী নয়।
নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে ছুটলাম অটো’তে। মসজিদটি
প্রথম দর্শনেই তৃপ্তিবোধ হল। ইমাম সাহেবের বয়ান চলছে।
যাবার সময় অটো চালক জানিয়েছিলেন,মসজিদে বসলে নাকি
চোখে ঘুম চলে আসে। তার কথায় মুচকি হেসে মিথ
ভেবেছিলাম। কিন্তু একি হায়!আমার চোখেও যে জগতের সকল ঘুম
ভর করার প্রাণপন চেষ্টা। অজু ভাঙ্গার ভয়ে বেশ কষ্ট করেই চোখ মেলে
রাখি। নামাজ শেষে সুলতানি আমলের তৈরী মসজিদটি ঘুরে ঘুরে
দেখি। ১৬ শতকের তৈরী এই মসজিদটি বিখ্যাত দরবেশ হযরত কুতুব
শাহ [রঃ] এর নামে রাখা হয়েছে। তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের
মধ্যে, সবচাইতে দৃষ্টিনন্দন সুলতানী স্থাপনা এই কুতুবশাহ
মসজিদ। প্রায় সাড়ে চারশ বছরের অনন্য স্থাপত্য। মসজিদটির
নির্মাণকাল লেখা কোন শিলালিপি না পাওয়া,এর সঠিক সময়কাল
জানা যায় না। তবে বেশীরভাগ প্রত্নতত্তবীদদের মসজিদটির
স্থাপত্য রীতি ও নির্মাণশৈলী দেখে, ১৬ শতকে সুলতানী আমলের
হবে বলেই ঐক্যমতপোষণ করেন। মসজিদটির ৫টি সুদৃশ্য গম্বুজ
রয়েছে। এর দেয়ালে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য।মসজিদের পাশেই
রয়েছে একটি কবর। ধারণা করা হয়,এটি হযরত কুতুব শাহ [রঃ]
কবর।মসজিদটির রয়েছে ৪টি মিনার। ৫টি প্রবেশপথ। ১৯০৯ সনে
তৎকালীন প্রতœতত্ব অধিদপ্তর, কুতুব শাহ মসজিদটি সংরক্ষিত
হিসেবে নথিভুক্ত করে। এরপর চলে যাই অষ্টগ্রামের বিখ্যাত পনির
চেখে,ইকুরদি গ্রামের সুস্বাদু মুড়লি খেতে। এই মুড়লির
বিশেষত্ব সাত ইঞ্চি লম্বা। যা দেশের অন্যকোথাও মিলে না। মুড়লি
আর গাছপকা চাম্পা কলা,খেয়েদেয়ে সঙ্গে নিয়ে ফিরছি এবার
ট্রলারে। হাওরে ভেসে ভেসে, দুপুরের আহার চলে। সাদাভাতের সঙ্গে
আইড় মাছের টলটলে ঝোল। আহ্ধসঢ়; কি টেস্ট। ট্রলার চলতে চলতে,
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সারাদিনের তেজোদিপ্ত সূর্যটা রক্তবর্ণ
আভা ছড়িয়ে – পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। ঠিক ভর সন্ধ্যায় সূর্য
মামা’র নিলীমায় মিলিয়ে যাওয়ার চমৎকার দৃশ্য,আপনার হাওর ভ্রমণের
পরিপূর্ণতা এনে দিবে নিশ্চীত।
চলেন যাইঃ ঢাকার মহাখালী ও সায়েদাবাদ হতে কিশোরগঞ্জগামী
এসি/নন এসি বিভিন্ন পরিবহনের বাস সার্ভিস রয়েছে। ভাড়া
২২০/= হতে ৪০০/= টাকা। এছাড়া ট্রেনে চড়েও যাওয়া যাবে।
কমলাপুর হতে সকাল ৬টা ৩০ মিনিট হতে ১০টা ৩০ মিনিট
পর্যন্ত তিনটি ট্রেন ছেড়ে যায়। দিনে দিনে ফেরার জন্য সকালে
যাওয়াই ভালো। শহর হতে করিমগঞ্জের মরিচখালী বাজার পর্যন্ত
সিএনজি যায়।
ভ্রমণ তথ্যঃ– অষ্টগ্রাম হাওর দেখতে হলে আগের রাতেই কিশোরগঞ্জ
চলে যাবেন। কারণ কাকডাকা ভোরে ট্রলারে না চড়লে ফেরা যাবে
না। শুধু মাত্র ছাতিরচর দেখতে চাইলে,মরিচখালী যাবার প্রয়োজন
নেই।সকালে নিকলী গিয়ে, ট্রলারে আসা-যাওয়া ঘুরা,সব
মিলিয়ে তিনঘন্টাতেই সেরে ঢাকা ফেরা যাবে। এছাড়া
কুলিয়ারচর হয়েও অষ্টগ্রাম যাওয়া যাবে। অষ্টগ্রাম রাত থাকতে
হলে,জেলা পরিষদের ডাকবাংলো আগেই বুকিং দিয়ে যেতে হবে।
ছবির ছৈয়ালঃ দে-ছুট
ভ্রমণ সংঘ
আর্টিকেলটি নিয়ে আলোচনা